নদীর ওপারে নীল আকাশ। এপারে নদীর কালো জল। একটা বড় ট্রলারের ধাক্কা জলকে আরো ঘোলা করে দিয়ে গেলো। আমার শাড়ীর কালো আচঁল নৌকা বেয়ে জলের সাথে খেলায় মেতে উঠেছিল। তুমি বললে, 'এই কি করছ, নোংরা জলে ওত মাখামাখি কেন?' আমি মুচকি হেসে এক মুঠো জল তোমার মুখে ছিটিয়ে দিলাম। তোমার সে কি অভিমান, আর আমার সে কি বাধঁ ভাঙা হাসি। আমার হাসিতে অবশেষে তোমার মন গলে মোম হল। তুমি আমায় কাছে টেনে নিতে নিতে বললে, 'অত দূরে কি ভাল লাগে?' আমি আবারো কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে হাসলাম। এই হাসিটা তোমার খুব প্রিয় তাই না। আমার হাসি শোনার জন্য তুমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা কর তা আমি জানি। এজন্যই তো এত হাসি। তোমাকে অপেক্ষায় রাখতে আমার যে একটুও ভাল লাগে না।
সেদিন বিকেলটা বড় ভাল ছিল তাই না। নদীর ঢেউ আর বাঁধ ভাঙা ভালবাসা মিলে মিশে একাকার। তোমার বুকে মাথা রেখে গুনগুন করে গেয়ে উঠল মন। তোমার স্পর্শে আমি যেন বারে বারে ক্লান্তির পথ ভুলে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। চোখ বুজলেও তুমি ছিলে আমারই সামনে, দেখছিলাম তোমাকে মন ভরে। আকাশ বাতাস যেন হিংসেয় জ্বলছিল আমাদের দেখে। তুমি মিটিমিটি হাসলে আর আমি বললাম, 'জ্বলুক না, পুরে ছাই হয়ে যাক'। আবারো সে কি হাসি তোমার। জানো, তোমার এই কাচ ভাঙা হাসি আমার ভীষন ভাল লাগে। বুকের মাঝে যেন ঝড় উঠে তোলপাড় করে দেয়। তুমি হাসলে মনে হয়, আমার আর কিছুই চাইবার নেই। সব পাওয়া হয়ে গেছে। তুমি একটু পর পর বলছিলে, 'শোনা, আজ তোমায় শাড়ীতে কি যে সুন্দর লাগছে!' আমি আবারও নিঃশব্দ হাসিতে ভেঙে পরলাম। মনে মনে বলি, 'সবই তো তোমার জন্য, বোঝ না তুমি?'
ধীরে ধীরে গোধুলি নামল আকাশ ছেয়ে, নদীর জলে সোনালি ছায়া। কালো জলের অমন স্বর্নালী রূপ আমি আগে দেখিনি। তুমি সাথে ছিলে বলেই হ্য়ত প্রকৃতির আজ এত সাজ। তুমি হঠাৎ ডেকে বললে, 'এই দেখ দেখ, কি দারুন চাঁদ'। আমি গেয়ে উঠলাম গুনগুন করে ...
" চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো,
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে ... "
একাকী বন্দী পাখির মত সোনার খাঁচায় বন্দী আমার প্রান, দুবেলা খাবার পানি জোটে জোটে অনেক সম্মান, কিন্তু যতই কর আদর, যতই দাও প্রেম বন্ধ হয়ে আসে আমার নিঃশ্বাস।
আদর করে আমায় কেউ সোনার ময়না বলে ডাকে, বুক ভরে সোহাগ করে আমার আপনজন। তারপরও লাগে না ক্ষুধা, লাগে না তৃষ্ণা মন বসে না আমার কোন কাজে।
উড়ে যেতে পারি না ডানা মেলে সুদূর অনন্ত অম্বরে, খোলা আকাশে মেঘের দেশে যে দেশে বসত করে আমার আপনজন। মন চায় ছুটে যেতে সেখানে, যেখানে অপেক্ষায় আছে আমার একান্ত প্রিয়জন।
সোনার খাঁচার বন্দিনী মনের কথার গান গেয়ে যাই গুনগুন করি সারাদিন সুরে, আমার মাঝে নেই আমি আজ ডুবে যাই অতল গহবরে।
বন্দী আমি স্তব্ধ আমি সুখের খোঁজে পাখা ঝাপটিয়ে মরি, সোনার খাঁচার সোনার আলোয় ছটফট করি পিপাসায়, আর্তনাদ করি তবু কেউ শুনতে পায় না সোনার পালঙ্কে ঘুম আসে না বড় কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি।
ঘুম ভেঙে জেগে দেখি আমার পাশে তুমি নেই, বিছানাটা পরে আছে অগোছালো তোমার বালিশটা ঠিক তেমনি আছে যেমনটি তুমি ঘুম থেকে ওঠার পর রেখে যাও।
নেমে দাড়াই এলোমেলো শাড়িতে আচঁলটা টেনে ঠিক করে নিই ভাবি, তুমি হয়ত এতক্ষনে গোসল সেরে নিয়েছ। মনে মনে মুচকে হাসি, একটা ভীষন ভাললাগার অনুভূতি অন্তরে নাড়া দিয়ে যায়।
আজঁলা ভরা জলে নিজেকে রাঙিয়ে দিয়ে মনটাকে তাজা করি হঠাৎ মনে পড়ে যায়, আজ আবারো ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলো তুমি নিশ্চয়ই নাস্তার অপেক্ষা করছ।
দৌড়ে ঢুকি রান্নাঘরে, দ্রুত হাতে টিফিন রেডি করে তোমার অপেক্ষায় বসি খাবার টেবিলে। মনে মনে ভাবি, কাল থেকে তোমাকে নিজ হাতে জাগাব বেড টি হাতে নিয়ে ভেবে ভেবে ক্ষনিকের জন্য ভালবাসায় মনটা আন্দোলিত হয়।
ইশ, এই অসময়ে টেলিফোন কার? ধ্যাত, মেজাজটা খিচরে ওঠে হ্যালো, ... ওপাশ থেকে আপার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর 'কিরে তুই রেডি হয়েছিস, কখন থেকে কল করছি শোন, হালকা আকাশী শাড়িটা পরে নিস কথা বলছিস না কেনো রে ভুলে গেছিস, আজ যে ১ম বার্ষিকী সব আয়োজন আমি একা কি করে সামলাই'
হঠাৎ আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে আমার দুনিয়াটা এক নিমেষে উজার হয়ে যায় মনে পড়ে যায় আজ এদিনে তুমি আমার ঘুম না ভাঙিয়ে চলে যাও চিরতরে ... বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে কান্নায় ভারি হয়ে আসে দুচোখ ভাবি, কাল থেকে নিজ হাতে কি করে ঘুম ভাঙাবো তোমার, তুমি যে ঘুমিয়ে আছো পরম শান্তিতে।
জীবন নদীর মোহনায় মন ছুটে চলেছিল উদ্দাম নৌকোর মত সমূদ্রের সাথে মিলনের সময়ই যেন বাঁধা দিল অদৃষ্ট নিয়তি, ভাগ্যের কি বিরুপ পরিহাস একাকীত্ব আমায় আজ দিচ্ছে নিমন্ত্রন।
অশ্রুধারা যেন সমুদ্রের ঢেউএর মত আছড়ে পড়ে বারবার জীবন উপকূলে বাধ ভাঙা শ্রোত যেন অন্ধের মত শুধু ছুটেই চলে, নিয়তির এ কঠিন নিয়ম গুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
এ দঃখ ভাগ করে নেবার কেউ নেই বলে একাকী চলেছি আজ পথে পথে, কারও সহানুভুতি, কারও এতটুকু স্বান্তনা মনকে আরও অশান্ত করে তোলে।
ভালবাসাকে সঙ্গী করে নিয়েছি বলে হয়তো আজ আমি এতোটা নিঃসঙ্গ, আজ যেন আমি এক অঙ্গার অনির্বান আমি, শুধু জ্বলছি আর জ্বলছি নিঃসঙ্গ জীবনটাকে চিরসঙ্গী করে।